শিবেন্দু নাগ: আজ থেকে অনেক বছর আগে মহালয়ার পুণ্যলগ্নে শ্যামসুন্দরী মায়ের আবির্ভাব তিথি। ঐ দিন মা প্রথম দর্শন দিয়েছিলেন। শ্যামসুন্দরী মায়ের মন্দিরের জনৈক পুরোহিত মায়ের পুজোর জন্য বাজার করতে গিয়েছিলেন।
বাজার করতে গিয়ে পুরোহিত লক্ষ্য করেন পাঁচ বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে গায়ে কালো রঙ, চোখে লাল রং মেখে মা কালীর মত সেজে সবার কাছ থেকে ভিক্ষা চাইছেন।
মা শ্যামসুন্দরী মন্দিরের পুরোহিতের কাছেও সেই বাচ্চা মেয়েটি বলল “একটা টাকা দেয়না, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে রে, আমি দুদিন ধরে কিছু খাইনি”।
তখন সেই পুরোহিত বাচ্চা মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলেন “যা কাজ করে খা”, বাচ্চা মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “যদি কাজই পেতাম তো তোর কাছে কি ভিক্ষা চাইতে আসতাম?”
এরপর বাচ্চাটিও চলে যায় আর পুরোহিত তার পছন্দ মত মায়ের ভোগের জন্য ফল, মিষ্টি, চাল, ডাল সবকিছুই অনেক বেশি পরিমাণে ক্রয় করে মন্দিরে চলে আসেন। সে দিন মায়ের মন্দিরে অন্ন ভোগের ব্যবস্থা করা হয় এবং প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়।
ঐ মন্দিরের একটি বিশেষ নিয়ম রয়েছে। প্রত্যেক অমাবস্যায় মায়ের পুজো অন্ধকারে হয়, শুধুমাত্র দীপান্বিতা অমাবস্যা অর্থাৎ কালীপুজোর দিনে আলো জ্বালিয়ে মায়ের পুজো হয়। আজ অবধি সেই রীতি পালন করা হচ্ছে মন্দিরটিতে।
মহালয়ার পূন্যলগ্নে সে অমাবস্যায় ঠিক অন্ধকারেই মায়ের পূজো করা হচ্ছিল, পুজো চলতে চলতে হঠাৎ পুরোহিত লক্ষ্য করলেন যে মহাদেব আছেন অথচ মা নেই। পুরোহিত মনে মনে ভাবলেন, মা তো কালো তাই অন্ধকারে মাকে দেখা যাচ্ছে না, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘিয়ের প্রদীপটা মায়ের সামনে নিয়ে যান এবং তিনি দেখেন যে সেখানে কেউ নেই, মহাদেবও যেন মৃত মানুষের মতো শুয়ে আছেন, পুরোহিত ভয় পেয়ে দুইপা পিছনে সরে আসেন, তার গা ভয়ে শিয়রে ওঠে।
তখনই ছম ছম করে আওয়াজ হয়, কেউ যেন হেঁটে আসছেন। তার পিছন থেকে সেই মুহূর্তে একটি পা যেন মহাদেবের বুকে ধপ করে পড়ল। মায়ের মুখ যেন বেরিয়ে এলো ওই অন্ধকারের মধ্যে।
মা শ্যামসুন্দরী বললেন “দে চাল কলা খেতে দে, দিবি না আমায়”। মায়ের রুপ দেখে সেই পুরোহিত সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।
সেই অজ্ঞান অবস্থায় মা তাকে বলেন “আমি শুধু বড়লোকের মা নইরে আমি গরিবেরও মা, তাই আজ থেকে তুই যতই আমার জন্য বিশেষ পুজো করিস না কেন, যদি কোন ভক্ত এক মুঠো আতপ চাল আর একটি পাকা কলা আমার কাছে নিবেদন করে,আমার কাছে
সেগুলো থেকে বড় কিছু নেই”।
তাই আজও মাকে যে ভক্ত চাল, কলা নিবেদন করেন, মা সেই ভক্তগণের সকল মনস্কামনা পূরণ করেন। দয়াময়ী মা কাউকে খালি হাতে ফেরান না।
একটি আধ্যত্মিক বিষয়, আগে মায়ের বিগ্রহ বড় মেয়ের মত ছিল। কিন্তু মাকে এখন দেখলে মনে হয় পাঁচ বছরের ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে। বাজারে দেখা সেই মেয়েটি যেন অবিকল দাঁড়িয়ে আছে।
মায়ের কাছে বিখ্যাত গায়ক-গায়িকারা এসে শ্যামা সংগীত করেন, তাদের অগাধ বিশ্বাস মায়ের মত সুন্দর আর কোথাও নেই। ভক্তরা বলেন, মা দেখতে অদ্ভুত সুন্দর, মায়ের হাসিও অকৃত্রিম সুন্দর।
প্রত্যেক অম্যাবসায় শ্যামসুন্দরী মায়ের মন্দিরে ভক্তদের বিনামূল্যে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। প্রতিদিন মন্দির সকাল ৭টায় খোলা হয় , ভোগ হওয়ার পর দুপুর ১টায় মন্দির বন্ধ করা হয়। আবার বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা আটটা অবধি মন্দির খোলা থাকে।
অমাবস্যায় সারাদিন মন্দির খোলা থাকে। সেই দিন ভোর চারটা থেকে রাত বারোটা অবধি খোলা থাকে শ্যামসুন্দরী মায়ের মন্দির।
শ্যামসুন্দরী মায়ের মন্দির শিয়ালদা স্টেশন থেকে একদমই কাছে। বাস, অটো কিংবা হেঁটে শুকিয়া স্ট্রিট ধরে মানিকতলার আগে, রামমোহন হলের পেছনের বাড়িতে মায়ের মন্দির। সবার জন্য উন্মুক্ত মায়ের দর্শন। কলকাতার জীবন্ত কালী শ্যামসুন্দরী মা স্বর্ণ সাজে সজ্জিত। সোনার শাড়ি, নতুন সোনার মুকুট ও নানা সোনার অলংকারে ভূষিত মাতৃ রূপ দর্শন করে জীবন সার্থক করুন। অমাবস্যার দিন মায়ের দর্শন করলে মৃত্যু ভয়নাশ হয় এবং অমৃত লাভ হয়।
কাহিনীর তথ্যসূত্র: মায়ের সেবাইত ভৈরবী দয়াময়ী ঘুঙরু মাতাজি