শেখ মুজিবের উপর লেখা বইতে স্থান পেয়েছে প্রনব মুখার্জীর লেখা শেষ প্রবন্ধগুলোর একটি সুহাসিনী হায়দার নয়াদিল্লী, অক্টোবর ১৭, ২০২০, দ্য হিন্দু তে প্রকাশিত
১৯৭১ সালের জুনে, একজন তরুণ সংসদ সদস্য ভারত সরকারকে মুজিবনগরে অবস্থিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আলোচনা শুরু করলেন সংসদে। সে সময় এই অস্থায়ী সরকারের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান করাচি কারাগারে ছিলেন। ৩৬বছর বয়সী এই সাংসদ প্রণব মুখার্জি, বিশ্ব ইতিহাসে হস্তক্ষেপের নজিরগুলি নিয়ে এবং বাংলাদেশে যে নৃশংসতা ঘটেছে তাতে ভারতীয় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছিলেন।
“আমি একটি রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছি যার অর্থ স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান। রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম সরকারকে বৈষয়িক সহায়তা দেওয়া,” তিনি বলেছিলেন। এই ভাষণ এবং ১৯৭১ সাল ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর স্মৃতি নিয়ে দীর্ঘ এই নিবন্ধটি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গত আগস্টে মারা যাওয়ার আগে লিখেছিলেন শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে একটি নিবন্ধসংগ্রহের অংশ হিসেবে। ভয়েস অফ মিলিয়নস নামে বইটি এই বছর প্রকাশিত হলেও এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। প্রবন্ধটি আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ এবার ২২-২৩ মার্চ মুজিব শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের একটি বিশেষ অধিবেশন প্রণব মুখার্জির ভাষণ দেয়ার কথা ছিল এবং বইটির উদ্বোধনেও অংশ নিতেন তিনি।
তবে করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে ঢাকার অনুষ্ঠানগুলো বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল এবং যখন এগুলো অনুষ্ঠিত হবে, তখন প্রাক্তন সাংসদ, মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি তাতে অংশ নেবেন না। বইটির সম্পাদকদের মতে প্রণব মুখার্জীই একমাত্র বিদেশী ব্যক্তি যাঁকে লেখার অনুরোধ জানানো হয়েছিল এবং তিনি অনায়াসেই সম্মত হন তাতে। “প্রধানমন্ত্রীর ‘পরিবারের সদস্য’ হিসেবেই বইটিতে লেখার জন্য প্রণব মুখার্জীকে অনুরোধ করা হয়েছিল,” শেখ মুজিবের কন্যা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শতবর্ষ কমিটির অংশ আসিফ কবির। প্রণব মুখার্জীর একান্ত সচিব অভিজিৎ রায় বলেছেন, প্রয়াত রাষ্ট্রপতির সর্বশেষ প্রবন্ধটি লেখার জন্য মুজিবের জীবন ও রাজনৈতিক কর্মজীবন নিয়ে যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন ছিল এবং তিনি মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে তুলে এনেছিলেন, যা মুজিবের মৃত্যুর অনেক বছর পরে প্রকাশ করেন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরে মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং প্রণব মুখার্জী লিখেছেন, অনেক দিন ধরেই মুজিবকে এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে দেয়া হয়নি। সে সময় পাকিস্তানের ভাবী রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো তার সাথে আলোচনার চেষ্টা করেছিলেন। অবশেষে, ভুট্টো হাল ছেড়ে দিলেন এবং ভারতের সমর্থনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ জানাতে দিল্লীতে সংক্ষিপ্ত বিরতি দিয়ে মুজিব ঢাকায় ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে। বইটিতে শেখ হাসিনার একটি আবেগঘন লেখা রয়েছে, “আমার ভাইয়েরা” শিরোনামে। তিনি ও তাঁর বোন রেহানা একমাত্র বেঁচে গিয়েছিলেন যখন স্বাধীনতার কয়েক বছর পর ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব, তাঁর স্ত্রী, অন্যান্য সন্তান এবং তাদের স্ত্রীসহ (পরিবারের ১৫ জন সদস্য) নিহত হয়েছিলেন সেনা কর্মকর্তাদের হাতে।
পরবর্তী বছরগুলিতে, যখন শেখ হাসিনা নিজেকে নির্বাসনে রেখেছিলেন এবং পরিবারের সাথে দিল্লীতে বাস করছিলেন, তখন প্রণব মুখার্জী এবং তাঁর স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জীর মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হয়। শুভ্রা মুখার্জী দেশ ভাগের আগে পূর্ববঙ্গে বসবাস করতেন। প্রণব মুখার্জীর কন্যা এবং কংগ্রেস নেতা শর্মিষ্ঠা মুখার্জী বলেন, “বাবা-মাকে হারানো খুব কষ্টের, এমনকি সেটা স্বাভাবিক মৃত্য হলেও।” “শেখ হাসিনা যা কিছুর মধ্য দিয়ে গেছেন তা অকল্পনীয় এবং আমি মনে করি যে তাঁর এবং আমার বাবা-মায়ের মধ্যে বন্ধুত্ব আরও দৃঢ়় ছিল কারণ সে সময় তাঁর মানসিক সমর্থন প্রয়োজন ছিল।
” শর্মিষ্ঠা মুখার্জী স্মৃতিচারণ করে বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দিল্লী সফরকালে শেখ হাসিনা শুভ্রা মুখার্জীর বাড়িতে যেতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জী, তাঁর অস্বস্তির কথা হাসিনার কার্যালয়ে জানান। শেখ হাসিনার জবাব ছিল: “আমি মন্ত্রীর সঙ্গে নয় আমার বৌদির সঙ্গে দেখা করছি।“