বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
দুর্গাপূজার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ও সমাজকল্যাণে মহাশক্তির আহ্বান—প্রদীপ কুমার সাহা হান্ডিয়াল শ্রী শ্রী জগন্নাথধামের সেবাইত হৃদয় চৈতন্য গোস্বামী আর নেই সনাতন টিভি’র লন্ডন প্রতিনিধি দেশের প্রতিটি জেলায় মডেল মন্দির নির্মাণের ঘোষণা শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণ জীউর মন্দিরের সার্বজনীন শারদীয় দুর্গাপূজা কমিটি গঠন রাউজানে লোহার গ্রিল ভেঙে রাতের আঁধারে আদ্যাপীঠ মন্দিরে দুর্ধর্ষ চুরি অভিযোগ আলতা উৎসব ২০২৫ ক্ষুদে নক্ষত্ররা রাঙুক ঐতিহ্যের রঙে চট্টগ্রামে ‘রূপকথা ফটোগ্রাফি’র যাত্রা শুরু সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে শারদীয় দুর্গাপূজা সুষ্ঠুভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত সনাতনী স্বেচ্ছাসেবী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ফটিকছড়িতে গৃহহীনকে নতুন ঘর উপহার

দুর্গাপূজার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ও সমাজকল্যাণে মহাশক্তির আহ্বান—প্রদীপ কুমার সাহা

Spread the love

আমরা জানি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে দেবী দুর্গা হল মহাশক্তির প্রতীক। এই মহা পূজার মাধ্যমে আমরা সেই মহা শক্তিকেই প্রতিমার মধ্য দিয়ে চিন্ময়ী ব্রহ্ম শক্তিরূপে দর্শন করে থাকি । এই মহাশক্তি সাধারণ কোন বিষয় নয় যাহা আমরা এই বিশ্বজগতের সুক্ষ্ণ ক্রিয়ার প্রভাব দেখে সহজেই অনুমান করতে পারি। অমরা দেখি এই সৃষ্টির মধ্যে শত সহস্র অপূর্ব শৃঙ্খলা বিদ্যমান, যাহা প্রচ্ছন্নভাবে প্রতিনিয়তই নিখিল বিশ্বের মধ্যে ক্রিয়া পরায়ন এবং বুঝতে পারি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রত্যক্ষ ভাবে দেখা স্কুল সত্তার অন্তরালে এক বিশাল শক্তি সম্পন্ন সূক্ষ্ম সত্তা বিদ্যমান আছে, এই প্রকৃতিররাজ্যে বিভিন্ন ক্রিয়ার অভিব্যক্তির মধ্যে শক্তি বহুবিধ ব’লে প্রতীয়মান হলেও সব শক্তিই মুলতঃ এক। একই মূল শক্তি বিচিত্র ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচিত্র আকার ও উপাধি গ্রহণ করে, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আত্মপ্রকাশ করে। যেমন কালী, দুর্গা, তারা, কাত্যায়নী, ব্রহ্মচারিণী ইত্যাদি। আমাদের প্রাণ, মন,বুদ্ধি ও এক চৈতন্যময়ী শক্তিরই বিচিত্র রূপ। এই শক্তির প্রভাবে আমাদের অন্তরের মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তনগুলি সাধিত হয়।

এই পবিত্র স্থান শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণ জীউর মন্দির প্রঙ্গনে আপনারা নিষ্ঠা, শ্রম, একাগ্রতা ও ভক্তিপূর্ণ মনোভাব নিয়ে সেই চৈতন্যময়ী মহাশক্তিকে আহ্বান করার প্রস্তুতিতে ব্রতী হয়েছেন – তা সত্যিই প্রশংসনীয় ও অনুপ্রেরণাদায়ক। আপনাদের নিরলস প্রচেষ্টা, সুষ্ঠ পরিকল্পনায় আমরা শৃঙ্খলা, সংযম ও নিষ্ঠা বজায় রেখে পুজা সম্পন্ন করতে পারব বলে আশা করি এবং এই চৈতন্যময়ী মায়ের কৃপায় আমাদের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক চেতনার জাগরণ ঘটবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। শুধু দূর্গপুজা নয় আপনারা যেন আরও বহু শুভ কাজের ধারক ও বাহক হয়ে সমাজে অবদান রাখতে পারেন সেজন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি। আমরা যে মূর্তি বা প্রতিমাকে পূজা করি, এই মূর্তি কোন সাধারন মূর্তি নয়, অনন্ত অসীম মহাশক্তির প্রতীক। নিরাকার ঈশ্বরের সাকার উপাসনা ।

সনাতনী দর্শন অনুসারে এই পূজা শুধুমাত্র আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা ভক্তি, শৃঙ্খলা, আনন্দ ও নির্ভেজাল আত্মত্যাগ এবং আত্মোন্নতির মিলন ক্ষেত্র। চিত্তের আবেগই এই অনুষ্ঠানের প্রান, ঈশ্বরানুভূতিই এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য।”

 

সত্যকে জীবনের মধ্যে আনিতে হইলে অনুষ্ঠান চাই। কতগুলি বাহ্যিক আরম্বরই ইহার সব কিছু নয় চিত্তের আবেগ, হৃদয়ের আকুতি প্রভৃতি ভাবময় বস্তু ও অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্তলীন ড. মহানাম ব্রত ব্রহ্মচারী।এতে বুঝা যায় দুর্গাপূজার বাহ্যিক অনুষ্ঠানগুলি যত সুষ্ঠু, শৃঙ্খলাপূর্ণ ও শ্রদ্ধাচারে করা হবে ততই সমাগত সকলের মনে দূর্গা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি ও আত্মনিবেদনের ভাব বৃদ্ধি পাবে। অন্তরে লুকায়িত অসুরভাব বিনাশ হবে। আমরা সাধন সংগ্রামে জয়ী হব। এজন্য প্রতিমা নির্বাচন, পুরোহিত নির্বাচন, আরতি, ভোগ নিবেদন, শ্রীশ্রী চণ্ডী পাঠ প্রভৃতি ব্যাপার গুলি শাস্ত্র সম্মত ভাবে এবং সার্বজনীন কল্যাণের দিকে দৃষ্টি রেখেই করা উচিত।

আমরা বাস্তব জীবনে সাধারণতঃ ধর্ম-অধর্মের যুদ্ধ, নিজের মধ্যে দৈবভাব ও অসুরভাবের যুদ্ধ তথা সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক শক্তি সমূহের সাথে নিয়ত সংঘর্ষের মধ্যেই বাস করি। এই সংঘর্ষ নিজের মধ্যে বা পরস্পরের মধ্যে সংঘটিত হয়। যেমন আমরা যখন কোন শুদ্ধ চিন্তায় মগ্ন থাকি তখন অবচেতন মনে মন্দ একটা বিষয় পাশাপাশি উপস্থিত হয়ে নিজের মধ্যে সংঘর্ষ করে, বিভ্রন্তির সৃষ্টি করে। এটাই হল আমাদের অন্তরে অবস্থিত দৈবী ও আসুরিক শক্তির যুদ্ধ বা সংঘর্ষ। এই আসুরিক শক্তির প্রভাবে আমরা সহজে ভাল কিছু করতে পারি না, মন্দ কাজ করে ঘৃনিত হই, অধঃপতিত হই, পরস্পরের সহিত অহেতুক ঝামেলায় জরায়ে পরি । তাই আমরা এই সংঘর্ষে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেদের মধ্যে দৈবী শক্তিকে জাগ্রত করার জন্য বিশ্বজননী মহাশক্তিকে আমাদের সম্মুখে অসুরমর্দিনী, ধর্মসংস্থাপিনী শক্তিরূপে আবির্ভূত হবার জন্য পূজার আয়োজন করি এবং এই পুজার মাধ্যমে দেবীর চরণে আন্তরিক প্রার্থনা নিবেদন করি যাতে আসুরিক শক্তির প্রভাব থেকে আমাদেরকে মুক্ত করে।কারণ আসুরিক শক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়াকেই জীবনের মুক্তি বলে যাহা আমরা প্রতিনিয়তই কামনা কওে থাকি। তান্ত্রিক মতে বিশ্বজননী মহাশক্তি মা দুর্গা সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিনটি গুণে গুণান্বিত-চণ্ডীতে উল্লেখ আছে। এই তিনটি গুণের মধ্যে সত্ত্ব গুণ নির্মল,আমরা চাই আমাদের অন্তরে দুর্গা মায়ের দৈবী শক্তির উত্থান ও আসুরিক শক্তির বিনাশ যাতে আমরা সত্যের পথে চলতে পারি । তাই আমরা মায়ের বিশুদ্ধ সত্ত্বময়ী গুণের পূজা করে থাকি। মূল উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে আমাদের মধ্যে যে রজঃ এবং তমঃ গুণে আশ্রিত আসুরিক ও তামসিক শক্তি সমূহ রয়েছে সেগুলোকে বলিদান করে নিজেদের ভিতর দৈবী শক্তিকে জাগ্রত করা তথা সত্ত্ব গুণের অধিকারী হয়ে মায়ের আরাধনা করা। মায়ের কৃপাতে জ্ঞান, ভক্তি, পবিত্রতা লাভ করে মনের অশুভ চিন্তা, প্রবৃত্তি ও কর্মকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলে আমরা এই সাধন সংগ্রামে জয়ী হব। আমাদের জীবনে সত্ত্বগুণ সমুজ্জ্বল হয়ে উঠবে, মনের মধ্যে লুকায়িত যত হিংসা, বিদ্বেষ, কলুষতা ক্রমে দূরীভূত হবে। আমাদের মন, বুদ্ধি, হৃদয় ক্রমশঃ উন্নত আধ্যাত্মিক ভূমিতে আরোহণ করবে। আমরা যে বলি দুর্গা মায়ের বিসর্জন, আসলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোন শক্তির বিসর্জন হয়না। শক্তির কোনরূপ বিনাশ নাই। সুতরাং মহামায়ার মহাশক্তিকে আমরা বিসর্জন দিতে পারি না। আসলে আমরা মায়ের চরণে আমাদের আসুরিক শক্তিগুলিকে বিসর্জন দিয়ে থাকি যাতে ভগবতী মহামায়া এই শক্তিকে যথাযথভাবে জগতের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারে। তাই দূপুজার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা যথাযথ ভাবে সম্পন্ন করতে পারলে আমাদের দূর্গাপুজা সার্থক ও সফলতা লাভ করবে।

পক্ষান্তরে কেউ যদি আসুরিক ও তামসিক শক্তি গুলিকে প্রবল করে মাকে প্রদর্শন করে এবং শাস্ত্রীয় বিধান না মেনে যেন-তেন ভাবে একটা পুজার আযোজন করে শুধু মাত্র উপভোগ করার জন্য উৎসাহিত করে তাহলে তারা মায়ের কাজ থেকে আসুরিক শক্তি লাভ করে। যদি এমন হয় তাহলে মানুষের প্রকৃত চেতনা লোপ পায়, মানুষ আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না, মানুষের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ তথা পশুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীতে পশু যোনিতে জন্ম হয় বা নরকগামী হয় যাহা শ্রীগীতায় উল্লেখ আছে। তাই ভাবতে হবে কোন ধরনের আনন্দ উপভোগ বা বিনোদন আমাদের মনকে কলুষিত করে আর কোনটা করে না। যে আনন্দ বা বিনোদন মানুষের মনকে কলুষিত করে, অন্যের মূল্যবোধকে আঘাত করে, যে আনন্দের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই এবং প্রতি মুহূর্তে বিপদের আশংকা থাকে তাহা প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করা হতে পারেনা। সুতরাং সেই আনন্দ বা বিনোদন থেকে বিরত থাকা উচিত। সাধক সাধনাকে ভালবাসে নিজের জন্য, নিজের আনন্দের জন্য, তাঁদের আনন্দের স্থান দেবস্থলী, মন্দির ইত্যাদি। পিতা মাতার আনন্দ পুত্র কন্যাদের ভালবাসার মধ্য দিয়েই হয়-নিজ গৃহে। চোরের আনন্দ অন্যের গৃহে অনুপ্রবেশে। অন্যের মূল্যবোধকে আঘাত করে অন্যায়ভাবে পূজায় আনন্দ উপভোগকারী মূর্খদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে অন্য কোন ঘৃনিত স্থানে, দেবস্থলী বা পূজা মণ্ডপে নয়।

শক্তি ভোগের বস্তু নয়। এই মাতৃরূপা মহাশক্তি বিশ্বের সকল দেবতা ও মানবের আশ্রয় স্থল। মায়ের আরাধনাতেই নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতির দ্বারা সাধক শান্তির অধিকারী হয়। পক্ষান্তরে সমাজ দুর্নীতি পরায়ণ হইলে ও শক্তিরূপিনী মাকে ভোগ করিতে চেষ্টা করিলে, ফল শুভ হয় না তন্ত্রমতে ইহা আসুরিক প্রয়াস। — – ড. মহানাম ব্রত ব্রহ্মচারী
আমাদের অন্তরে যদি দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস না থাকে তাহলে সাত্ত্বিক ভাবে পূজা সম্পন্ন করা কখনও সম্ভব নয় । অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের জননী এই দেবী হলেন সকলের পূজ্য, আমাদের ভালোবাসার স্থান, তিনি প্রতিমাতে পূর্ণরূপে বিরাজিতা থাকেন। এই শক্তিরূপিনী জাগ্রত প্রতিমাকে যদি যে কোন দেবস্থলীতে বা পূজা মণ্ডপে কোন হিতাহিত জ্ঞান বিবর্জিত মানুষ পূজা বা তান্ত্রিক দৃষ্টিতে না দেখে শুধুমাত্র আনন্দ উল্লাস করে উপভোগ করার চেষ্টা করে, বেসামাল আনন্দ উচ্ছ্বাসে মেতে উঠে, তাহলে ফল শুভ হয় না। সেই অঞ্চলের মানুষ চরমভাবে অধঃপতিত হয়। গোটা সমাজ কলুষিত হয়। তাই আধ্যাত্মিক ভাবধারায় পুষ্ট আমাদের পবিত্র এই সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য সনাতনী সম্প্রদায়ের সকল সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। যারা অজ্ঞানবসত শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করে কোন মতলবে ধর্মকর্মের ভাব ধরে মানুষকে বিপথে চালিত করে, যারা ধর্মকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে, মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন বিষয়কে ধর্ম বলে মনে করে তাদের সঙ্গ বর্জন করা উচিত। নৈতিক জ্ঞান ও বুদ্ধিতে সমুন্নত না হলে সমাজের কল্যাণ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পবিত্রতা এবং সভ্যতাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই দুর্গা মায়ের কাছে প্রার্থনা করি মা আমাদেরকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান কর আমরা যেন সকল অপশক্তিকে নির্মূল করতে পারি, প্রত্যেকটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পবিত্রতা রক্ষা করতে পারি। আসুন আমরা সবাই মিলে মৈত্রী ও মমত্ববোধে সকল ভেদাভেদ ভুলে পরষ্পরের কল্যান তথা জগতের মঙ্গল কামনায় আকুল হৃদয়ে দুর্গা মায়ের চরণে প্রার্থনা নিবেদন করি। সবার জীবনে মা দুর্গার ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত হউক এই কামনাই করি । “সবাইকে অগ্রিম শারদীয়া শুভেচ্ছা”

লেখকঃ প্রদীপ কুমার সাহা, সভাপতি, শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণ জীউর মন্দির (ধর্মঘর) পরিচালনা পরিষদ।



আমাদের ফেসবুক পেইজ