গণিত কথাটির অর্থ হল গণনা সম্পর্কীয় শাস্ত্র। এটি বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান শাখা। গণিতের শুরু কবে ও কোথায় এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। অনেকের মতে গণিতের আদিভূমি মিশর। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। এর কারণ সেই সময় ব্যাবিলন এবং চীন এর পাশাপাশি আমাদের ভারতবর্ষেও উন্নতমানের গণিত চর্চা হত, যার স্বপক্ষে বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই অনেক পণ্ডিতের মতে ভারতবর্ষই গণিতশাস্ত্রের উৎপত্তি স্থল। প্রশ্ন আসতে পারে এমন দাবি করার পিছনে যুক্তি কী? সিন্ধু সভ্যতাকেই ধরে নেওয়া হয় ভারতের মাটিতে গণিতের পথচলার শুরুর সময়কাল। কারণ, এর আগের কোনো সভ্যতার নিদর্শন আজও আমরা খুঁজে পাইনি। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে যে লিপির নিদর্শন পাওয়া গেছে তা আজও পাঠ ও মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। তাই সে যুগের গণিতচর্চার প্রকৃত স্বরূপ আজও আমাদের অজানা। তবে ধ্বংসাবশেষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন নিদর্শন দেখে একথা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, এই উপত্যকাবাসীদের গণিতজ্ঞান যথেষ্ট উন্নতমানের ছিল। এই সভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল ৩৫০০ – ৩৩০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে। সুতরাং ভারতীয় গণিতই প্রাচীনতম কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মিশর, সুমেরীয় বা চীনের থেকে যে পিছিয়ে ছিল না এ কথা অনস্বীকার্য।
এরপর প্রায় ১০০০ বৎসর গণিতের মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে হিন্দুদের বিশেষ একটা অবদান লক্ষ্য করা যায় না। পরবর্তীতে আর্যভট্ট্(৪৭৬-৫৩০),ব্রহ্মগুপ্ত(৫৮৮-৬৬০ খ্রিঃ), বরাহমিহির(ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ), গলস্ন (ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম ভাগে), ভাস্কর(ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে), মহাবীরাচার্য (নবম শতাব্দী ), শ্রীধর আচার্য (একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ), শ্রীপতি (একাদশ শতাব্দী), ভাস্করাচার্য (দ্বাদশ শতাব্দী) প্রমুখ মনীষীবৃন্দের কর্মালোকে হিন্দু গণিতশাস্ত্র আবার বিশ্বসভায় নিজের স্থান সুদৃঢ় করে তোলে। গণিতশাস্ত্রে হিন্দু মনীষীদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অবদান হল দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন পদ্ধতি ও ‘শূন্য’ এর আবিষ্কার। অবশ্য এর আগে খ্রীষ্টপূর্ব ২০০ তে পিঙ্গলের ‘ছন্দসূত্রে’ শূন্যের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আর্যভট্ট রচিত ‘আর্যভটীয়’ নামক গ্রন্থে দ্বিঘাত প্রথম মাত্রার অনির্ণেয় সমীকরণের সমাধান ও π এর নির্ভুল মান এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্গমূল নির্ণয়ের পদ্ধতিও আর্যভট্টের আবিষ্কার। এসময়ের আরেকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন ব্রহ্মগুপ্ত। তিনি পিরামিড ফ্রাস্টাম এর আয়তন নির্নয় সম্পর্কিত সূত্র আবিষ্কার করেন। যাঁর কথা না বললে এই লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে তিনি হলেন ভাষ্কর। তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থখানি হল চারখন্ডে সমাপ্ত‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’। যার প্রথম ২টি খন্ড লীলাবতি ও বীজগণিত এ পাটীগণিত ও বীজগণিত এর বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে। “একটি ঋণাত্মক রাশিকে অপর একটি ঋণাত্মক রাশি দ্বারা গুণ করলে ধনাত্মক রাশি এবং একটি ঋণাত্মক ও অপর একটি ধনাত্মক রাশি গুণ করলে ঋণাত্মক রাশি পাওয়া যায়”, বীজগনিতের এই সিদ্ধান্ত ভাষ্কর এর আবিষ্কার। গণিত এর ছাত্র মানেই, “x=(-b±√(b^2-4ac))/2a” সূত্র সম্পর্কে অবগত। যার আবিষ্কারকের নাম শ্রীধর। দ্বিঘাত সমীকরণের মাত্রা নির্ণয়ের এইসূত্রটি ‘শ্রীধরাচার্যের উপপাদ্য’ নামে প্রচলিত। এতো গেল পাটীগণিত ও জ্যামিতির কথা। এরপর ত্রিকোণমিতি। ত্রিকোণমিতিতেও হিন্দুদের সাফল্য অনস্বীকার্য। বরাহমিহির‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’ গ্রন্থে sin30 ও sin 60 এর মান নির্ণয় করে দেখিয়েছেন। বর্তমান ত্রিকোণমিতিতে ব্যবহৃত মূল সূত্রগুলিও বরাহমিহির এর আবিষ্কৃত।
এই হল আমাদের হিন্দুধর্ম; আমাদের গণিতশাস্ত্র; যার মাহাত্ম্য, যার অবদান বলে শেষ করা যাবে না। হাজার হাজার বছর আগে যখন পৃথিবীতে জ্ঞান ও ধর্মকে একত্রিত করা হয়েছিল ঈশ্বরের উপাসনার জন্য, ঠিক তখন থেকেই আমাদের ভারত উপমহাদেশেও জ্যামিতি, গণিত ও ধর্মের বিভিন্ন রীতির সংমিশ্রন ঘটেছিল। সেই সময় হিন্দুধর্ম তথা সনাতন ধর্ম এতটাই সমৃদ্ধশালী ছিল যে, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ভাবতেই অবাক লাগে যে সময় পৃথিবীর অধিকাংশে মানবসভ্যতার ছোঁয়া পর্যন্ত লাগেনি তখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন আশ্রমে ঋষিগণ নিমগ্ন ছিলেন বিজ্ঞানের মহাযজ্ঞে। এর কারণ বৈদিক যুগে এদেশের সমাজ ব্যবস্থা মূলত ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ধর্ম কর্মের জন্য প্রয়োজন হত নানা ধরণের যজ্ঞাদি ক্রিয়া কান্ড। এই যজ্ঞানুষ্ঠানের একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল যজ্ঞবেদী নির্মাণ। যার জন্যই সংখ্যা ও জ্যামিতির বিভিন্ন বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যই গণিতবিদ ও পুরোহিতদের অনুপ্রাণিত করেছিল গণিতশাস্ত্রকে বিভিন্ন ধর্মবিষয়ক কাজে ব্যবহার করার। আর সেই থেকেই শুরু হয় ভারতবর্ষে হিন্দুদের গণিতচর্চা। এই লেখাটি লিখতে গিয়ে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছে। প্রতি মুহূর্তেই আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি গণিতশাস্ত্রে হিন্দু মনীষীদের অতুলনীয় অবদান দেখে। আর এই জন্যই আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারি, সনাতন ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়েছে জ্ঞানের পথে। ঈশ্বর সকলের মঙ্গল করুক, এই কামনায় এখানেই শেষ করছি।
জয় সনাতন ধর্মের জয়।